Tuesday, October 20, 2009

রাজধানী তে চড়ার ইচ্ছে আমার বহুদিনের‍‍‍‍ I সেই সুযোগ এসে গেল ২০০৮ এর পুজোয় হিমাচল যাবার সময় I সৌরভ যাবে দিল্লী থেকে I সেই জন্য আমাদের প্রথম গন্তব্যস্হল দিল্লী I সেইমত ২দিন ধরে ২টো Suitcase এ প্রয়োজনমত (আমারটাই বেশী অবশ্য) শীতের পোষাক নেওয়া হল, কারণ আমি বেশ শীতকাতুরে মানুষ I 3rd October আমরা তিনজন শিয়ালদা থেকে ট্রেনে চেপে বসলাম I ঘন্টায় ঘন্টায় খাবার খেয়ে আর গুল্লুর দুষ্টুমি সহ্য করে ক্লান্ত হয়ে পরদিন সকাল ১০টায় নতুন দিল্লী পৌঁছলাম I সৌরভ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল I আমরা ওর বাড়ি গিয়ে দুপুরের স্নান-খাওয়া-বিশ্রাম সেরে একটু আগে বেরিয়ে দিল্লীর কিছু বিশেষ বিশেষ জায়গা ও দেখে নিয়ে পুরনো দিল্লী চললাম রাতের কালকা মেল ধরার উদ্দেশ্যে I ট্রেন প্রায় দেড়ঘন্টা দেরীতে এলেও পরদিন ঠিক সময়মত ভোর ৪:৩০ এ কালকা পৌঁছলাম I ওখান থেকে একটা গাড়ি নিয়ে ২:৩০ ঘন্টায় সোজা সিমলা, এক সুন্দর পাহাড়ি শহর I

সেদিন ছিল সপ্তমী I আমাদের হোটেল ম্যালের থেকে নীচের দিকে I ঠিক হল একটু বিশ্রাম নিয়ে স্নান সেরে ম্যালের উদ্দেশ্যে যাব I কারণ পাহাড়ে সন্ধ্যে হয়ে গেলে বেরিয়ে কোন লাভ নেই I সেইমত দুপুর ১২ টার মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম I প্রথমে ঠিক হল আগে সিমলা কালীবাড়ী যাওয়া হবে পূজো দেখতে I কিন্তু সেই কালীবাড়ীর রাস্তা যে এত কঠিন, তা কে জানত ! বুঝলাম কষ্ট না করলে ভগবান দর্শন মেলে না I গুল্লু আর সৌরভ তাদের চেহারার গুনে যতটা তাড়াতাড়ি যেতে থাকল, আমরা দুজন ঠিক ততটাই পিছনে I এ যেন খরগোশ আর কচ্ছপের দৌড় I এরকম করেই একসময় কালীবাড়ী পৌঁছে গেলাম I কিন্ত কোথাও সেভাবে পূজোর রেশ চোখে পড়ল না I কিছুক্ষণ মন্দিরের চারদিক ঘুরে গেলাম ম্যালের দিকে I চারপাশের তৈরী রেস্তোরা, স্কুল, চার্চ, ডাকঘর ( এক বিরাট বাড়ী বললেও চলে ) - এইসব দেখে বৃটিশদের সৃষ্টি খুব সহজেই অনুমিত হয় I আমরা পেটের ভিতর দৌড়াদৌড়ি করতে থাকা ছুঁচোকে শান্ত করার জন্য একটা ভালো রেস্তোরা দেখে ঢুকে পড়লাম I বেশ ভালোই খাওয়া দাওয়া হল I পুনরায় ম্যালে ফিরে এলাম I ম্যালে বসে নানারকম মানুষ দেখতে আমার বরাবরই খুব ভালো লাগে I একটা Bench ফাঁকা পেয়ে বসে বেশ আরাম করে সবে কফিতে চুমুক দিয়েছি, ব্যাস নামলো ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি I ম্যালের যত লোক আছে, সবাই মিলে একসাথে একটা ছাউনির নীচে জড়ো হয়েও মাথা ছাড়া আর কিছুই সেভাবে বাঁচানো গেল না I বৃষ্টি থামতে ঠিক হল এবার Shortcut ধরে তাড়াতাড়ি ফিরব, কারণ জামাকাপড় বেশ ভেজা I রাস্তা না চেনার জন্য বেশ খানিকক্ষণ ধরে একই রাস্তায় ঘুরপাক খেয়ে অবশেষে Hotel এ পৌঁছলাম যখন, তখন বেশ সন্ধ্যে নেমে এসেছে I রাতের খাবার ঘরেই দিয়ে গেল I খানিক গল্প করে শোয়ার তোড়জোর শুরু হয়ে গেল, কারণ পরদিন থেকে আমাদের আসল বেড়ানো শুরু হবে I

পরদিন সকালে উঠে দেখি চারদিক মেঘে ঢাকা আর প্রচন্ড জোরে ঝোড়ো হাওয়া বইছে I সাথে ভীষণ বৃ্ষ্টি I অপেক্ষা করতে থাকলাম বৃ্ষ্টি থামার জন্য I এদিকে আমাদের গাড়ির চালক অজয় ভগত্ এসে অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য I তাড়াহুড়োতে Suitcase এর Lock গেলো আটকে I কি মুসকিল ! এদিকে কানঢাকা টুপি রয়ে গেছে ওখানে I শেষপর্যন্ত ৩ জনের চেষ্টায় কাঁটাচামচের সহযোগিতায় Lock টিকে ভেঙ্গে ফেলে টুপি পাওয়া গেল I আর Suitcase কে একটা ছোট তালা দিয়ে সুরক্ষিত করা হল I বেলা ১১টা নাগাদ বৃষ্টি কমলে আমরা বেরিয়ে পড়লাম I রাস্তায় প্রচুর গাছ পড়ে থাকতে দেখলাম I আর বেশ কিছু গাছ পড়ব পড়ব করে ও দাঁড়িয়ে আছে, যেকোন সময় পড়ে যেতে পারে I অজয় সেজন্য খুব আস্তে এবং সাবধানে গাড়ি চালাতে লাগল I রাস্তায় একটা খুব খারাপ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলাম কিছুক্ষণের মধ্যেই I একটা নীল রঙের গাড়ি রাস্তার মাঝখানে ভেঙ্গে পড়ে আছে আর তাকে ঘিরে বেশ কিছু লোক I সামনে গিয়ে অজয় খবর নিয়ে এল যে ২জন যাত্রী নিয়ে একটা গাড়ি যাচ্ছিল, ধ্বস নেমে গাড়ির ওপর পড়ায় যাত্রীরা সমেত গাড়ি একেবারে শেষ I খুবই খারাপ অভিজ্ঞতা I আরও ঘন্টাখানেক যাবার পর নারকান্ডা পৌঁছলাম I Hotel এর নাম ওখানকার Peak টির নাম অনুসারে রাখা, হাটু I মালপত্র নামিয়ে রেখে তখনি রওনা হলাম হাটু Peak দেখতে I প্রায় ৩.৫ কি.মি. রাস্তা I এর উচ্চতা ৩,৪০০ মি. বা ১১,১৫২ ফিট I প্রচন্ড হাওয়া আর অসম্ভব ঠান্ডা, প্রায় কাঁপুনি লেগে যাবার মত অবস্হা ( আমার ই বেশি অবশ্য )I সামনে তাকিয়ে সব ভুলে গেলাম I হিমালয়ের অপরূপ শোভায় সুসজ্জিত নন্দাদেবী, নন্দাঘুন্টি, ত্রিশূল, কামেট I এখানে কোন জনবসতি নেই I শুধু একটা দুর্গামন্দির আর তার পুরোহিত I তখন বিকেলের পুজো চলছিল I আমরা কিছুক্ষণ পুজো দেখলাম I পুরোহিত মশাই বললেন, আমাদের প্রসাদ Hotel এ দিয়ে আসা হবে, কারণ যেহেতু Hotel টা HPTDC র, তাই এই মন্দিরের প্রসাদ ওখানে দিয়ে আসা হয় I আমরা ফিরে এসে দেখি গুল্লু প্রচন্ড উত্তেজিত, কারণ সে তার School এর এক বন্ধু কে পেয়ে কি যে করবে ঠিক পাচ্ছে না I আমরা ও একটু শান্তি পেলাম এই ভেবে যে, কিছুক্ষণ আমরা একটু গল্প করতে পারব, কারণ তখনো পর্যন্ত গুল্লু কে সঙ্গ দেবার সেরকম কেউ ছিল না বলে মাঝেমাঝেই ও সৌরভ কে ওর সাথে খেলা করার জন্য আমাদের আড্ডায় বসতে দিত না I রাতে এখানে বেশ ভালো ঠান্ডা I রাতের খাবার দেখে আমরা নিতান্তই ভীষণ খুশি হলাম I অত্যন্ত সুস্বাদু Chicken Roast, Chilly Chicken আর রুটি I আর দিল ওদের নিজেদের (HPTDC) তৈরী Apple Wine, যা খুবই সুস্বাদু এবং পরিবেশন ও করল অত্যন্ত যত্নসহকারে I আর ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচার জন্য Room Heaterও দিয়ে গেল I

পরদিন সকালে চোখে আলো পড়ায় ঘুম ভেঙ্গে গেল I আগের দিনের মেঘ কেটে চকচকে রোদ উঠেছে I আমরা তাড়াতাড়ি উঠে পড়লাম বেরোতে হবে বলে I প্রাতঃরাশের সঙ্গে একটা বাটিতে অন্যরকম এক খাবার দেখে কৌতূহলবশতঃ জিঞ্জাসা করে জানলাম যে ওটা সেই দূর্গামন্দিরের প্রসাদ I ওটা হল মহাভোগ, যা এখনো মুখে লেগে আছে I যাই হোক, খাওয়াপর্ব শেষ করে গুল্লুর‍ বন্ধুদের বিদায় জানিয়ে আমরা আবার গাড়ীতে চড়লাম I এবারের গন্তব্যস্হল Hidden Himachal. এটিকে Hidden বলার কারণ হল এই রাস্তা বা এই জায়গা এখনো অনেক লোকেরই অজানা I জাতীয় সড়ক ধরে চলতে চলতে কিঙ্গলের কাছে এসে এক অপূর্ব দৃশ্য চোখে পড়ল I দূরে দুই পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে শতদ্রু (Satlej) বয়ে চলেছে প্রায় ১৮০ ডিগ্রী পথ ধরে I এটা মিলিটারী দের দ্বারা সুরক্ষিত এলাকা I এখানে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ তাদের প্রশিক্ষন দেখে রওনা হলাম জালোরী পাসের (Jalory Pass) উদ্দেশ্যে I রাস্তা থেকে দুপুরের খাবার Pack করে নেওয়া হল I ঠিক হল জালোরী পাসে গিয়ে খাবারের সদ্ব্যবহার হবে I সেখানে পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় দুপুর ২টো বেজে গেল I রাস্তা জনমানবশূন্য I শুধু একটা দোকান আছে, যেখানে কেবল চা আর ডিম পাওয়া যায় I আমরা সঙ্গের খাবার বের করলাম I ওই হিমাচলী দোকানদার ভদ্রলোক আমাদের কাগজের থালা দিল আর সঙ্গে এক এক বড় গ্লাস ঘন চা I ওই ঠান্ডায় ওরকম চা পেয়ে আমরা যে কি খুশী হলাম তা বলাই বাহুল্য I শীত কাটানোর জন্য উনুনের আগুনটা ও বাড়িয়ে দিল I আহারপর্ব সেরে পুনরায় যাত্রা শুরু নাগনীর খোঁজে I

বেশ ঘন্টাখানেক যাবার পর বুঝলাম যে কোন একটা পাহাড়ী গ্রামে এসে পড়েছি I সাথে সাথে চলেছে এক পাহাড়ী নাম না জানা নদী I লোকজন যাকেই রাস্তায় পাওয়া যাচ্ছে, কেউই আর সঠিক উত্তর দিতে পারে না I আর মুস্কিল হল অজয় ও কোনদিন এই জায়গার নাম শোনে নি I এরকম চলতে চলতে বেশ কিছু বাড়ী চোখে পড়ল, যার একটার মধ্যে লেখা ‘TROUT VALLEY’ I বাড়ীটা বাইরে থেকে দেখে একদমই HPTDC র Hotel গুলোর সাথে মিল পেলাম না I বুঝলাম এটা Home Stay I বাড়ীর মালিক বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিলেন I আমাদের গাড়ীটা থামতে দেখে এগিয়ে এসে বললেন যে উনি আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছেন I আমরা স্বভাবতই খুব অবাক হয়ে জানলাম যে, একমাত্র ২টো বাড়ীতেই HPTDC তাদের Home stay বানিয়েছে আর যারা এই বাড়ীগুলো booking করে, একমাত্র তারাই এই গ্রামে ঢোকে I তাই বাড়ীর মালিক খেমজী আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন I কারণ একমাত্র আমমরাই বাকী ছিলাম আসতে I ভিতরে ঢুকে অসম্ভব ভালো লাগল I পুরো বাড়ীটা কাঠের I দোতলায় ৩টে ঘরের মধ্যে ২টোয় আমাদের থাকার ব্যবস্হা করা হয়েছে I সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ব্যাপার হল, যে নদীটা এতক্ষণ আমাদের পথ চেনাচ্ছিল, সেই নদীর পাড়েই এই বাড়ী I খেমজীর কাছে জানলাম এই নদীর নাম তীর্থন I আর এই নদীতে প্রচুর Trout মাছ পাওয়া যায় বলে বাড়ীটার নাম TROUT VALLEY I অপূর্ব আতিথেয়তা এদের I আমরা জানলার পাশে দাঁড়িয়ে নদীর তীব্রগতিতে বয়ে যাওয়াকে উপভোগ করতে না করতেই চমন গরম গরম চা নিয়ে এসে হাজির I ওরা ও বসে আমাদের সাথে চা খেল I মনে হল যেন কারো বাড়ী বেড়াতে এসেছি I আমাদের খাওয়াবার জন্য খেমজী নিজে বাজার গিয়ে একটা আস্ত মুরগী আর সোনালী রঙের আপেল কিনে আনলেন I আমরা তখন নদীর পাড়ে, গুল্লু যথারীতি অজয়ের সাথে বন্ধুত্ব পাতিয়ে নিয়ে নদীর জলে নুড়ি ফেলায় ব্যস্ত I এত আওয়াজ যে. চোখ বন্ধ করে দাঁড়ালে মনে হবে সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছি I বেশ সন্ধ্যেবেলা ফিরে এলাম যখন, তখন রান্নাঘর থেকে Chicken Roast এর দারুণ গন্ধ বেরোচ্ছে I যেদিকে নদী, বাড়ীটার সেদিকে সার দিয়ে জানলা I সেই জানলার ধারে বেশ কেয়কটা চেয়ার ও টেবিল পাতা I সেখানেই চমন আমাদের ধোঁয়া ওঠা Roast আর Golden Apple দিল বিকেলের জলখাবার হিসাবে I তখনই খেয়াল করলাম ঠান্ডা যেন ক্রমশঃ বাড়ছে আর সাথে নদীর দিক থেকে আসা প্রচন্ড ঠান্ডা হাওয়া I বেশ গোলটেবিল বৈঠকের মত গল্পের আসর বসল I আমরা ৩ জন, অজয়, খেমজী আর চমন I সে দারুণ গল্প, শেষ আর হয় না I রাত ১০টার সময় রাতের খাবারের সাথে আরও এক কাপ কফি দিল শীত কমানোর জন্য I তারপর যে যার ঘরে I

সকালবেলা চা নিয়ে চমন হাজির I এ যেন বাড়ীর থেকেও বেশী I চা খেয়ে সোজা তী্র্থনের পাড়ে সকালের সৌন্দর্য দেখার জন্য I খেমজী ও সাথে ছিপ নিয়ে হাজির I Trout মাছ ধরা হবে I বেশ নতুন অভিঞ্জতা I আরও একটা নতুন জিনিস দেখলাম I টোম্যাটোর মত দেখতে কিছু ফলের গাছকে পাখীর হাত থেকে বাঁচানোর জন্য জালের (Net) জামা পরিয়ে রাখা হয়েছে I ওই ফলগুলোর নাম Japani Fruit I Breakfast এর Menu হল টাটকা Trout মাছ ভাজা, ক্ষেতের আখরোট আর ভুট্টা, (দুটোই অত্যন্ত মিষ্টি খেতে), জাপানী ফল (যা নারকেলী কুলের মত খেতে) আর সোনালী আপেল I মালপত্র সব গাড়ীতে I এবার আমাদের বেরোনোর পালা I আবার আসব এই কথাটা বাড়ীর কর্তাকে দিয়ে গাড়ীতে উঠে বসলাম I চললাম অট (Aut) এর দিকে Highway ধরব বলে I এবারের গন্তব্যস্হল মানালী I

সেই গল্প না হয় আবার একদিন হবে I শুধু পাঠকবন্ধু দের কাছে একটাই অনুরোধ, সিমলা থেকে মানালী যদি কখনো যাও, তাহলে নারকান্ডা আর নাগনী র জন্য ২টো দিন সময় হাতে নিয়ে যেও I তারপর ফিরে এসে জানিও কেমন লাগল I

1 comment: